বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও মহালয়া
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও চন্ডী পাঠ।
মহালায়ার চণ্ডী পাঠ হিসেবে পরিচিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়। ভারতীয় সম্প্রচারকারী, নাট্যকার, অভিনেতা, অধ্যয়নকারী এবং থিয়েটার পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয় সর্বাধিক পরিচিতি তার মহিষাসুরমর্দিনী নামক বেতার সঙ্গীতালেখ্যটির জন্য। তাঁর জান্ম ৪ আগস্ট ১৯০৫ সালে এবং তিনি ৩ নভেম্বের ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয় কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ১৯৩০ এর দশক থেকে সুদীর্ঘকাল অল-ইন্ডিয়া রেডিওর বেতার সম্প্রাচারকের কাজ করেন। এবং সেই সময় থেকে এখনও মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় কলকাতার আকাশবাণী থেকে এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এই অনুষ্ঠানের ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেছেন। এখনও সেই রেডিও-তেই মহালয়া শোনেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মেয়ে। সেই ঘর, সেই খাট, সেই টেবিল এবং সেই রেডিও! আজও আছে। একই রকম। মহালয়ার ভোরে ওই রেডিও খোলা হয়। গোটা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর...! মহালয়ার সকালে মহিষাসুরমর্দিনীর কিংবদন্তী রূপকার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বাড়িতে আজও যেন ফিরে আসে অতীত! রামধন মিত্র স্ট্রীটের ওই গলিতে পা দিলে সময় যেন পিছিয়ে যায় হু-হু করে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ একাধিক নাটকে অভিনয় ও পরিচালনার কাজও করেন। ১৯৫৫ সালে নিষিদ্ধ ফল নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছিলেন তিনি।
১৯০৫ সালের ৪ আগস্ট উত্তর কলকাতায় মামার বাড়িতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। তার পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ও মা ছিলেন সরলাবালা দেবী। পরবর্তীকালে ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর কেনা ৭, রামধন মিত্র লেনে উঠে আসেন তার পরিবারবর্গ। কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। নিম্ন আদালতে দোভাষীর কাজ করতেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। কালীকৃষ্ণ পুলিশ কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী কালীচরণ ঘোষের দ্বিতীয় সন্তান সরলাবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৯২৭ সালে তিনি "রায়বাহাদুর" খেতাব পান। কালীকৃষ্ণের দুই পুত্র জন্মায় - ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ১৯২৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন।
হলুদ রংয়ের একটা বিশাল বাড়ির সামনে সাদা পাথরের ফলক। লেখা স্বর্গীয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সঙ্গে জন্ম-মৃত্যুর তারিখ। তার নীচে পাথরে খোদাই করা তিনটে লাইন, 'এই বাড়িতেই আমৃত্যু বাস করেছেন বেতারে মহিষাসুরমর্দিনীর সর্বকালজয়ী অন্যতম রূপকার এই সুসন্তান।'
ঠিক তার পাশেই সবুজ রংয়ের বিশাল কাঠের দরজা। ওঠার পথেই রাখা বিশাল এক বেলজিয়াম কাঁচের আয়না। উপরে হরিণের শিংওয়ালা মাথা। দোতলায় পৌঁছেও পাওয়া গেল না কাউকে। সামনে খোলা ছাদ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বড় প্রিয় জায়গা ছিল এই ছাদ।নীচে তাকালেই পুজোর দালান। আধো অন্ধকারে ছাওয়া। ছাদের পাশ দিয়ে চার-পাঁচ ধাপের একটি সিঁড়ি পেরিয়ে একটি ঘর দেখা গেল। অন্ধকার ঘরে শুয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনি সঞ্জীব ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ভাইপো। আঙুল তুলে দেখালেন উল্টোদিকের একটা ঘর। আরও কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পৌঁছনো গেল সেই ঘরে। দরজায় কড়া নাড়তেই সামনে এলেন এক বৃদ্ধা। তিনি সুজাতা ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বড় মেয়ের বয়স এখন ৮৭।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় অল ইন্ডিয়া রেডিওয়।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ একাধিক ধ্রুপদি কাহিনিকে বেতার নাট্যের রূপ দেন। ১৯৩০-এর দশকে তিনি যোগ দেন অল ইন্ডিয়া রেডিওয়। এই সময় থেকেই দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে দুই ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এই অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন। আজও দুর্গাপূজা শুরু হয় এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মেস নং ৪৯ সহ একাধিক নাটক রচনা করেন। বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাসটিকে তিনি মঞ্চায়িত করেছিলেন। ১৯৫২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সুবর্ণ গোলক গল্পটিকে তিনি নাট্যায়িত করেন।
মহিষাসুরমর্দিনী যখন সরাসরি রেডিওতে সম্প্রচার হত, তখন রাত দুটোর সময় গাড়ি আসত রেডিও অফিস থেকে। পরে যখন রেকর্ডিং প্রচার করা শুরু হল, তখনও ওই সময়টায় রেডিও অফিসে চলে যেতেন তিনি। তবে শেষদিকে আর যেতে পারতেন না। সুজাতা দেবী বললেন, 'এই ঘরে, এই খাটে বসেই আমরা বাবার সঙ্গে অনুষ্ঠান শুনতাম। আমি, আমার ভাই বাবা-মা।' বীরেনবাবুর ছেলে অবশ্য আজ প্রয়াত।
আর একবার রেডিও অফিসে যাননি তিনি। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। রেডিও-তে সে বার মহিষাসুরমর্দিনী প্রচারিত হয়নি। হয়েছিল, 'দুর্গা দুর্গতিহারিণী'। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে যা উত্তমকুমারের মহালয়া বলে প্রচলিত। সেই প্রথম, সেই শেষ। সে দিনের কথা বলতে গিয়ে আজও যেন যৌবনে ফিরে যান সুজাতা দেবী। বললেন, 'ওই অনুষ্ঠানের আগে এক রাতে উত্তমকুমার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন বাবার কাছে। হাত ধরে বলেছিলেন, তিনি ওই অনুষ্ঠানটি করতে চাননি। বাবা তখন উত্তমবাবুকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, 'কেন করবেন না আপনি? অবশ্যই করুন। নতুন কিছু তো করা দরকার। আমি আপনার পাশে আছি।' সেই মহালয়ার ভোরেও বাবা এই খাটে বসে অনুষ্ঠানটি শুনেছিলেন। ছোট্ট প্রতিক্রিয়া ছিল, 'ভালই তো করেছে!' জনতা অবশ্য সেটা মানেনি। সে কী বিক্ষোভ! আজও মনে আছে, প্রবল চাপে ষষ্ঠীর সকালে আবার রেডিও বাজাতে বাধ্য হয়েছিল মহিষাসুরমর্দিনী।'
এই ঘটনার উপর ২০১৯ সালে চিত্রপরিচালক সৌমিক সেন মহালয়া নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে রূপদান করেন শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়। অন্যদিকে উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেন যীশু সেনগুপ্ত।
২০০৬ সালের মহালয়ার দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্যা সুজাতা ভদ্র সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেডের তরফ থেকে তার পিতার এই মহান কীর্তির রয়্যালটি স্বরূপ ৫০৯১৭ টাকার চেক পান।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণর জিনিসপত্র, ছবি অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে আজ। হারায়নি শুধু স্মৃতি। আজও মহালয়ার সকালে বেজে ওঠে রেডিও। ওই তো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন তিনি। ধুতি, গায়ে সাদা উত্তরীয়,উল্টে আঁচড়ানো চুল। হাতে নস্যির কৌটো। খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ভোরের আলোয় অপেক্ষায়।
গোটা বাড়ি জুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়ছে, 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে...!'
তাঁর চণ্ডী পাঠ শুনতে আজও প্রায় সকলে ভোরে উঠে মহালয়ার ভোরে। গা শিহরিত করা চণ্ডী পাঠ মানুষের হৃদয়ে বেজে উঠে। তিনি তাঁর চণ্ডী পাঠের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
Translate in English
Birendrskrishna Bhadra and Chandipath.
Biography of Birendrskrishna Bhadra.
Birendrakrishna Bhadra Mahasaya, known as Chandi Path of Mahalaya. Indian broadcaster, playwright, actor, researcher and theater director Birendrakrishna Bhadra Mahasaya is best known for his radio musical Mahishasurmardini. He was born on 4 August 1905 and lived until 3 November 1991. Birendrakrishna Bhadra Mahasaya was a resident of Calcutta. He has been a radio broadcaster for All India Radio for a long time since the 1930s.
And from that time onwards, the show is still broadcast on Akashvani in Kolkata at 4 am on the day of Mahalaya. Virendrakrishna has recited the commentary and verses of the show. The daughter of Birendrakrishna Bhadra still listens to Mahalaya on that radio. That room, that bed, that table and that radio! Even today. Same. The radio was opened in the early hours of the morning.
Spread all over the house, 'Ashwin's autumn, Alokmanjir has sounded ...! In the morning of Mahalaya, the legendary narrator of Mahisasurmardini, Birendrakrishna Bhadra's house seems to be back to the past even today! When Ramdhan steps on that alley on Mitra Street, time seems to go back and forth.
Birendrakrishna also acted and directed several plays. He also wrote the screenplay for a film called Forbidden Fruit in 1955.
Birendra Krishna was born on 4 August 1905 at his uncle's house in North Calcutta. His father was Rayabahadur Kalikrishna Bhadra and his mother was Saralabala Devi. Later, his family came up to Ramdhan Mitra Lane, bought by Grandma Jogmaya Devi. Kalikrishna Bhadra was a polyglot. He knew 14 languages. He worked as an interpreter in the lower court. Later he became a well-known personality in the world of Bengali literature.
Kalikrishna married Saralabala Devi, the second child of Kalicharan Ghosh, a prominent police court lawyer. In 1926, he was given the title of "Ray Bahadur". Kalikrishna had two sons - Bhupendrakrishna and Birendrakrishna. Birendrakrishna graduated from Intermediate in 1926 and Scottish Church College, Calcutta in 1926.
A white stone slab in front of a huge yellow house. Written by the late Birendrakrishna Bhadra. With date of birth-death. Beneath it are three lines engraved in stone, 'This is the house where this Susanta, one of Mahisasurmardini's all-time greats on the radio, has died.'
Right next to it is a huge green wooden door. A huge Belgian glass mirror placed on the way up. Deer horned head above. No one was found on the second floor. Open roof in front. This roof was Birendrakrishna's favorite place. Pujo building when you look down. Shaded in semi-darkness. A house was seen crossing a four-five step staircase along the roof.
An old man was lying in a dark room. He is Sanjeev Bhadra. Virendrakrishna's nephew. He pointed to a room on the opposite side. We reached the room by crossing a few more steps. An old woman came knocking on the door. She is Sujata Bhadra. Birendrakrishna Bhadra's eldest daughter is now 8 years old.
He started his career on All India Radio.
Birendrakrishna turned several classical stories into radio dramas. He joined All India Radio in the 1930s. From this time onwards, on the occasion of Durga Puja, he joined the two-hour musical Mahisasurmardini program based on the mythology of Goddess Durga. The program was written by Banikumar Bhattacharya and the music was directed by Pankajkumar Mallick. Birendrakrishna recited commentaries and verses. Even today Durga Puja begins through this ceremony.
Birendrakrishna wrote several plays including Mess No. 49. He staged the novel Bimal Mitra's Saheb Bibi Golam. In 1952, he staged the story of Bankimchandra Chattopadhyay's Golden Sphere.
When Mahisasurmardini was broadcast live on the radio, cars would come from the radio office at two in the morning. Later, when the recording began to be broadcast, he would still go to the radio office at that time. But in the end he could not go. Sujata Devi said, 'In this room, sitting on this bed, we used to listen to the program with my father. I, my brother and parents. ' Birenbabu's son is dead today.
He never went to the radio office again. That was in 1986. Mahisasurmardini was not aired on the radio that time. Was, 'Durga Durgatiharini'. To the tune of Hemant Mukherjee which is commonly known as Uttamkumar's Mahalaya. That first, that last. Speaking of that day, Sujata Devi should go back to her youth even today. He said, 'One night before the ceremony, Uttam Kumar came to our house to visit his father. Holding hands, he said he did not want to do that show.
Dad then encouraged Uttambabu and said, 'Why don't you? Of course you do. Something new needs to be done. I am by your side. ' Even in the morning of that mahalaya, my father sat on this bed and listened to the program. The short response was, 'Well done!' The crowd, however, did not agree. What a protest! I still remember that Mahisasurmardini was forced to play the radio again on the morning of the 6th due to strong pressure.
In 2019, director Soumik Sen made a film called Mahalaya based on this incident. In it, Shubhashish Mukherjee played the role of Birendrakrishna Bhadra. On the other hand, Yeshu Sengupta played the role of Uttam Kumar.
In 2006, this day Mahalaya, Sujata Bhadra, daughter of Birendrakrishna, received a check for Rs. 50917.00/-
Birendrakrishna's belongings, pictures, many things are lost today. Not just lost memory. Even today the radio rang in the morning of Mahalaya. He is coming up the wooden stairs. Dhoti, white scarf, combed hair. A sniffle in hand. Standing on the open roof, Birendrakrishna was polite. Waiting for the dawn light.
The whole house was then spreading, 'Ashwin's autumn morning ...!'
To this day, almost everyone wakes up in the morning to hear his Chandi recitation. The Chandi text that thrilled the body resounded in the hearts of the people. He is alive in the hearts of the people through his Chandi lessons.
Comments
Post a Comment